ভেদরগঞ্জে নদী জুড়ে নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার, অবৈধভাবে কোটি টাকার বালু লুট

আজকের শরীয়তপুর প্রতিবেদক:

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার পদ্মা ও মেঘনা শাখা নদীগুলোতে নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার দিয়ে চলছে অবাধে বালু উত্তোলন। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে নদীর বুক চিরে। একদিকে কোটি কোটি টাকার বালু লুট হচ্ছে, অন্যদিকে নদী ভাঙন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় এসব অবৈধ কর্মকান্ড চালাচ্ছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।

এভাবে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে সরকারের রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা, ধ্বংস হচ্ছে নদী এবং পরিবেশ। দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে ভেদরগঞ্জ ও আশপাশের এলাকাগুলো ভয়াবহ দুর্যোগের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর ব্রিজের পাশে চর হোগলা নদী, উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নের ছুরির চর ট্রলার ঘাট, চরসেনসাস ইউনিয়নের নরসিংহপুর ফেরীঘাট, দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়নের মাষ্টার ঘাট, বেড়াচাক্কি বাজার, কাচিকাটা বাজার, মরিছা কান্দি বাজার দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়নের মাল বাজার ব্রিজের পাশে, আরশি নগর ইউনিয়নের চর ফিলিজ বাজারের পাশে, নতুন বালার বাজার ঘাট সহ উপজেলার প্রায় পঞ্চাশটি স্পটে পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছেন চক্রটি। কয়েক মাস ধরে প্রতিদিনই নদী থেকে বালু বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।

একাধিক এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, এই বালু উত্তোলনের কারণে স্থানীয় স্কুল, রাস্তা-ঘাট ও সেতুর মাটি সরে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের তীব্রতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। স্থানীয়দের দাবি, অভিযানের নামে লোক দেখানো কার্যক্রম চালানো হয়, স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বছরে দু-একটি অবৈধ ড্রেজার মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও অধিকাংশই ধামাচাপা পড়ে যায়।

দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়নের মাল বাজার এলাকার জেলে আনিস ছৈয়াল বলেন, “রাতে নদীতে নামা যায় না, শব্দ আর আলোয় নদীটা যেন একেকটা কারখানা হয়ে যায়। বালু তুলতে তুলতে নদীর তলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাছও আর তেমন পাওয়া যায় না। প্রশাসন মাঝে মধ্যে যখন অভিযানে আসে তখন ড্রেজার মালিক খবর পেয়ে বালু তোলা বন্ধ করে দেয়। তারা চলে গেলে আবারও নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু হয়।”

ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন বলেন,”গত বছর আমার বাড়ির পেছনের নদীর অংশ থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তুলেছিল, এরপর বর্ষায় আমার উঠান ভেঙে যায়। এখন আমি আতঙ্কে থাকি কখন পুরো ঘরটা নদীতে চলে যায়। আমি উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম কিন্তু কোন কাজ হয় নি। আপনি দেখেন আমাদের এলাকায় কি ভাবে বালু উত্তোলন করা হয়? প্রশাসন কিছুই বলে না। এভাবে বালু উত্তোলন করা হলে গতবছরের মতো এবার বর্ষায় আমাদের এলাকার নদীর তীরবর্তী ঘরবাড়িগুলো বিলীন হয়ে যাবে। “

বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়নের এক ড্রেজার মালিক সফিক রাড়ী বলেন,”এটা এখন ওপেন সিক্রেট। মাসে মাসে কিছু লোককে টাকা দিলে আর কেউ ঝামেলা করে না। চাহিদা অনেক, সরবরাহ করতে হলে কিছুটা নিয়ম ভাঙতেই হয়।”

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এডভোকেট নুরুজ্জামান শিপন বলেন, এটা শুধু অবৈধ বালু উত্তোলন নয়, এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট। যেভাবে বাংলা ড্রেজার দিয়ে নদী কাটছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে নদীর গতি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ, কৃষি ও মানুষের জীবনে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।” তাই প্রশাসনের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি মোহাম্মদ মোজাহেরুল হক বলেন, “আমরা কয়েক দফা অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু অভিযানের খবর পেয়ে এসব ড্রেজার বিভিন্ন জায়গায় সরিয়ে ফেলে। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও জানাচ্ছি। খুব শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

Facebook Comments

About T. M. Golam Mostafa

Check Also

শরীয়তপুরের সখিপুরে ডোবা থেকে তরুণীর মরদেহ উদ্ধার

আজকের শরীয়তপুর প্রতিবেদক: শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুরে ডোবা থেকে অজ্ঞাত এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করেছে …

কপি না করার জন্য ধন্যবাদ।