শরীয়তপুরে ভাঙন প্রবণ এলাকায় বালুমহাল ইজারা, ভিটেমাটি হারানোর আতঙ্কে গ্রামবাসী 

আজকের শরীয়তপুর প্রতিবেদক:  

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচিকাটার পদ্মা নদীর ভাঙন ঠেকাতে একদিকে সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মাণ করছে বাঁধ, অন্যদিকে বালুমহাল ঘোষণা করে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন। 

এলাকাটি ভাঙন প্রবণ হওয়ায় এখান থেকে বালু উত্তোলন করা হলে ব্যাপক আকারে নদী ভাঙনের আশঙ্কা করে আতঙ্কে দিন পার করছেন স্থানীয়রা। হুমকির মুখে কাঁচিকাটা বাজার, বোর কাঠি বাজার, মরিচা কান্দি বাজার সহ দশ হাজার ঘরবাড়ি। প্রশাসনের এমন উদ্যোগের প্রতিবাদে বিক্ষোভে নেমেছে পদ্মা পাড়ের মানুষ চল্লিশ হাজার মানুষ। মানববন্ধন, সেতু মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসক স্মারকলিপি সহ হাইকোর্টে রিট করেছে তারা। 

এদিকে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ ছাড়া বালু মহাল ঘোষণার বার বার সতর্ক করেছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন করা হলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে ভাঙন দেখা দিতে পারে তীরবর্তী এলাকায়। 

এদিকে গত বুধবার (১১ জুন) দুপুরে শরীয়তপুরে পদ্মা সেতু কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড রক্ষা বাঁধের ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শনে এসে সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান নদীভাঙনের জন্য অবৈধ বালু উত্তোলনকে দায়ী করে ড্রেজার মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ড্রেজার চালানোর ফলে নদীর আশেপাশের এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ডকে সঙ্গে নিয়ে অবৈধ ড্রেজার জব্দ করার পাশাপাশি মালিকদের আইনের আওতায় আনা হবে। পদ্মা নদীতে বালুমহাল ঘোষণা করে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আরো বলেন, “জেলা প্রশাসকের অনুমতি রয়েছে কি না আমরা বিষয়টি দেখব। জেলা প্রশাসক যদি অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও জনস্বার্থবিরোধী অনুমতি দিয়ে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্র জানা যায়, গত বছরের মার্চ মাসে ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়নের পদ্মা নদীর ৭৭ নং মৌজার ২২ দশমিক ৬৩ একর জমি বালু মহাল ঘেষণার প্রক্রিয়া শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। ইজারা দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য তালিকাভুক্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বালু মহাল ঘোষণার অনুমতি চেয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। বছর না পেরোতে আবারও একই এলাকার আরেকটি মৌজায় বালুমহাল ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে জেলা প্রশাসন। প্রশাসনের এমন উদ্যোগে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে তাদের ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের বালু উত্তোলন প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে পদ্মার তীরবর্তী এলাকার প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ সাত কিলোমিটার জুড়ে নদীর পাড়ে গত ৩ মে মানববন্ধন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

জেলার তিনটি ভেদরগঞ্জ, নড়ীয়া ও জাজিরা উপজেলার মোট ২১টি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। প্রতি বছরই নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছেন পড়ে পদ্মা পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ । গেলো ১০ বছরে নদী ভাঙনে গৃহহীন হয়েছে এই অঞ্চলের অন্তত ২৫ হাজার পরিবার। গত ৫ বছরে ভাঙন ঠেকাতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে একাধিক বাধ নির্মাণ করেছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড।

দুই বছর আগে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়া রেজা বকাউল বলেন,“আমাদের এই চর রক্ষায় সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণ করছে। এখানে বালুমহাল ঘোষণা করলে সেই বাঁধও নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে কয়েকবার আমাদের ঘরবাড়ি ও দোকান সরিয়েছি। এবার বালু কাটা শুরু হলে দোকানপাট রক্ষা করা যাবে না।” 

স্থানীয় রুহুল আমীন জুয়েল বলেন,”গত বছর নদী ভাঙনে আমার বসতঘর চলে গেছে। সবকিছু হারিয়ে আমার পরিবার নিঃস্ব  হয়ে গেছে। এখন আবার শুনতেছি এখান থেকে বালু তোলা হবে। এইখানে বালু তুললে আমাদের কাঁচিকাটা শেষ হয়ে যাব। প্রশাসন কি আমাদের আবারও গৃহহীন করতে চায়? ইজারায় যদি বৈধভাবে ১০টি বোট অনুমোদন পায়, বাস্তবে ১০০টি বোট বালু কাটে। তাই আমরা সরকারের কাছে বালুমহাল বাতিলের জোর দাবি জানাই। এই ইজারা বন্ধ হোক, আমাদের বাঁচতে দিন।” 

স্থানীয় দুলাল মালত বলেন, “পদ্মা নদী শুধুই নদী নয় এটা আমাদের জীবন-জীবিকার উৎস। অথচ হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ ছাড়াই যেভাবে বালুমহাল ইজারা দেওয়ার চেষ্টা চলছে জেলা প্রশাসক, তা ভয়ঙ্কর। পানি উন্নয়ন বোর্ড তো নিজেই বলছে ভাঙনের আশঙ্কা আছে, তাও কেন এমন সিদ্ধান্ত? আমরা উন্নয়নের বিরুদ্ধে না। তবে তা যেন মানবিক ও পরিবেশসম্মত হয়। যদি বালু উত্তোলনের ইজারা দেওয়া বন্ধ না হয় প্রয়োজনে আমরা আরও আন্দোলনে যাব।”

নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এডভোকেট নুরুজ্জামান শিপন বলেন, পদ্মায় ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। পাশাপাশি কয়েকদিন ধরে নদী ভাঙ্গনও শুরু হয়েছে। কাঁচিকাটা এলাকার মানুষ সবসময় ভাঙ্গন আতঙ্কে দিন পার করে। তাদের ভিটেমাটি রক্ষায় মানববন্ধন সহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়েছে কাজের কাজ কিছুই হয় নি। শুনলাম জেলা প্রশাসক ওখানে বালু উত্তোলনের ইজারা দিবে এটা হাস্যকর। একদিকে হাজার কোটি টাকা ব্যায় করে নদী ভাঙ্গন রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে অন্যদিকে পাশেই ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে এতে সরকারের টাকা অপচয় ও কতিপয় কর্মকর্তাদের পকেট ভরি করা ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। আমি চাই নদীর তীরবর্তী মানুষের কথা চিন্তা করে এই ইজারা বাতিল করা হউক এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের যারা আছে তারা একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে সেখানে বালু উত্তোলন করুক। 

এ বিষয় জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তারেক হাসান বলেন, “ কাচিকাটা এলাকাটি ভাঙনপ্রবণ। নদীতে বালু জমে চর তৈরি হয়। যা সরাতে গিয়ে কখনো ভাঙন কমে, আবার কখনো বেড়ে যায়। তাই হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ ছাড়া বালু উত্তোলন করলে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে।”

এ ব্যাপারে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন বলেন, “বালুমহাল ঘোষণার জন্য পাউবো,পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর ইতিবাচক প্রতিবেদন পেয়েই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নেওয়া হবে।”

Facebook Comments

About T. M. Golam Mostafa

Check Also

শরীয়তপুরে ভ্যান ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ: নিহত ১

আজকের শরীয়তপুর প্রতিবেদক: শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলায় ভ্যান ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে আশ্রাফ আলী দর্জী (৭০) …

কপি না করার জন্য ধন্যবাদ।